Code

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Second Header

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

Sunday, October 4, 2015

কেমন আছো তুমি - ষষ্ঠ পর্ব

শহরে তখন সবে সন্ধ্যে নামছে। পশ্চিমের লাল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে ঘরফেরা পাখির ডানায়। কোনও রং বোঝা যাচ্ছে না। শুধু আভাময় বিকেলের শেষ রোদ্দুরে সব কিছু যেন আলো-আঁধারির সীমানা হয়ে গেছে। দূরের কোনও বাড়ির অ্যান্টেনা, চিলেকোঠা, কোনও বাড়ির ছাদে শেষ বেলাতেও ঘুড়ির নেশায় মত্ত কিছু ছেলে, অথবা একলা কেউ চায়ের কাপে ছোঁয়াচ্ছে ঠোঁট দূর কোনও ছাদের কিনারায়। মুখ দেখা যায় না, শুধু ছায়াময় কিছু অবয়ব। আর তারই নীচে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে রাতপরীর রূপকথারা। কোনও রূপসীর ঘন চুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কানের দুলের মত, রং বাহারি আলো জ্বলে ওঠে রাস্তায়, ঘরে, দোকানে, অফিসে, বাস আর ট্রামের ব্যস্ততায়। বাতি জ্বলে ওঠে একলা সরু গলির পোস্টে, গণিকার দরজায়।

তবু এই ঘরে এখনও আলো জ্বলেনি। মোবাইল আর ল্যাপটপ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে অবিন্যস্ত বিছানার ওপর। পর্দা তখনও সরানো, শেষ আলোটুকু দেখতে চায় সে। দেওয়াল সমান উঁচু জানালার আরশির মধ্যে দিয়ে শহরটাকে রাখতে চায় আতসকাঁচের নীচে। হাতে সদ্য ধরানো সিগারেট, এখনও ভেজা ঠোঁটের স্পর্শ পায়নি। আহেলি, শুধু চুপ করে বসে আছে জানালার বেড়ের উপর। হাঁটু দুটো বুকের খুব কাছে টেনে এনে, নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। বার বার নিজেকে ছুঁয়ে দেখছে। এই নিয়ে প্রায় তিন-চারবার মোবাইলটা বেজে গেছে। কৌশিকের ফোন। চশমাটা খুলে রাখল বিছানার ওপর, এলোমেলো চুল তার লাল চোখের পাতার ওপর এসে পড়ছিল। শক্ত করে বেণী বেঁধে, নরম গাল ছোঁয়ালো হাঁটুর ওপর। অন্ধকার খুব গাঢ় হয়ে এসেছে, তবু ওর ভ্রূক্ষেপ নেই। নিজের খেয়ালে বারবার ভেবে চলেছে "কেন এমন হল..."

তখনও ল্যাপটপে টুংটাং, ফেসবুকে হয়ত বারবার কেউ কথা বলতে চাইছে, কিন্তু আহেলির তাতে মন নেই। অনেকটা রিক্ত বোধ করছে সে। একবার তাকালো দূর থেকে স্ক্রিনের ওপর, আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। আহেলি তো অনেক কিছু চেয়েছিল জীবনে। পিকচার পারফেক্ট হবে ভেবেছিল। কিন্তু আদৌ হল কিনা সেটা আহেলি নিজেও জানে না। সিগারেটের ধোঁয়ার মত সব কিছু যেন উবে যাচ্ছিল। কেন জানি না, আজ বিকেল থেকেই আহেলির অনেক পুরনো বন্ধুর কথা মনে পড়ছিল। মাধবী, আবির, কুশান, রিতম, আর হ্যাঁ, অন্তুর কথা । বিকেলের ক্যানভাসে তুলির টান, অন্তু খুব সুন্দর ছবি আঁকত। সাধারণ ঘরের ছেলে, ছাপোষা; আঁকার হাত খুব ভালো ছিল। অনেকবার এঁকে দিয়েছে ছবি ওর জন্য। হয়ত আহেলিকে খুব ভালবাসত বলে। কিন্তু আহেলির মন ছিল জীবনের অন্য আরও বিচিত্র রঙের দিকে। অন্তুর জন্য সে থেমে থাকেনি।

দেখতে দেখতে প্রায় সাতটা বছর কেটে গেছে। নামী কর্পোরেট সংস্থায় চাকরি; শহর থেকে শহরে ছুটে বেড়িয়েছে, তবে বিভিন্ন সঙ্গীর সাথে। আসলে "আরও বেশি, আরও ভালো" এটার খোঁজে আহেলি কবে যেন ভালোবাসা কাকে বলে সেটা ভুলে গেছে। রয়ে গেছে শুধু শরীর, আর তার গেয়ে লেগে থাকা অসংখ্য চাহিদার দাগ। চাকরিটা তো সেও এইরকমই চেয়েছিল, উদ্দাম-দুরন্ত। কিন্তু ওই যে, বার বার নতুন কারও খোঁজ করতে গিয়ে, নিজের মনের খোঁজ রাখেনি সে। শুনেছে, অন্তুও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি। তার মত নামী চাকরি-স্বাচ্ছন্দ্য, দক্ষিণ কলকাতার বুকে এক মাসে আগে কেনা উঁচুতলার ফ্ল্যাট, অফিসের গাড়ি- এসব কিছুই জোটেনি তার কপালে। আহেলি খুশি হতো এটা ভেবে, যে সে ভুল করেনি- আত্মতৃপ্তি হতো অন্তুর ছাপোষা জীবন দেখে। নিজেকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে পেরেছে আহেলি- এই ভাবনাটাই তাকে জড়িয়ে রেখেছিল। তবে পরে জানতে পারে, অন্তু গত পাঁচ বছর সংসার করছে, বেশ সুখেই আছে মাধবীর সাথে। গড়িয়াতে বাচ্চাদের একটা আঁকার স্কুল চালায়।

আহেলিও তো সংসার করতে চেয়েছিল।কৌশিকের সাথে প্রায় দু' বছর হয়ে গেছে সম্পর্কের। তবে সেই সম্পর্ক শরীর ছাড়িয়ে মন অবধি পৌঁছায়নি। কোথাও যেন একটা খুঁত থেকে গেছে। আহেলি তো গান গাইতে ভালবাসত, নাচের শখ ছিল। আজ দুপুরবেলা, কেন জানিনা আহেলি সেই নূপুরগুলো বের করে পায়ে পড়েছে। আঙ্গুলের ছোঁয়ায় ধুলো সরিয়ে, পায়ের পাতায় রেখেছে। বার বার মনে পড়েছে, সেই পুরনো দিনের কথা। কোথায় হারাল সেই সব দিন। তবে কি আহেলি হতাশায় ভুগছে? নাকি কৌশিকের মত করে নিজেকে বানাতে গিয়ে দিনে দিনে আহেলিকে মেরে ফেলেছে তিলতিল করে। তার ভাবনা চিন্তা, পোশাক, ইচ্ছে সব কিছুই যেন আর তার মতো নেই।

আর এটাই যেন ছিল আরেকটা সম্পর্কের ইতি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস চেঞ্জ করে ভাবছিল, সোশ্যাল দুনিয়ায় তার অসংখ্য "ভালোবাসার" মানুষেরা উথাল পাথাল করে উঠবে, তার এই সদ্য আপডেট-এর জন্য। কিন্তু হায়! আহেলি সবার থেকে এতটাই দূরে যে ফোনে "তার আরেকটা সম্পর্কের" ইতিকথা শোনার মত সময় কারও নেই। সবাই নিজ নিজ সময়ে ব্যস্ত। ফেসবুকে তার স্ট্যাটাস এর চেয়ে, কোনও নতুন অভিনেত্রীর সদ্য মুক্তি পাওয়া স্বল্পবসনা ছবি নিয়ে তার বন্ধুদের মধ্যে আরও বেশি আলোচনা হয়েছে। ফ্রেন্ড অ্যান্ড ফলোয়ার নিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার "বন্ধু" নাকি তার সোশ্যাল পেজ-এ। সমব্যথায় কয়েকটা লাইক, অথবা কমেন্টে "নতুন পথ শুরু করার জন্য আগাম শুভেচ্ছা" ছাড়া কিছু জোটেনি। এমনকি অনেক "পুরনো সঙ্গী"রা আবার নতুন উদ্যমে যোগাযোগ করতে চেয়েছে।

সমাজ, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, ফ্রেন্ড লিস্ট - সবাই এত টুকুও বুঝতে পারল না, একটা মেয়ের সম্পর্ক শেষ হয়ে যেতে বসেছে। যাকে এতদিন ধরে সে ভালবেসেছিল আজ এক লহমায় সে হাত বাড়িয়েছে অন্য সঙ্গীর দিকে। আহেলি জানতও না যে কৌশিক গত তিন মাস ধরে অন্য কারও সাথে...। থাক সে কথা। কৌশিক চলে যাবার আগে শুধু বলেছে "বড্ড একঘেয়ে লাগছিল, তাই পরিবর্তন চাই..."। মা-বাবা ছাড়া আর কেউ বুঝতেও চাইল না যে তার চাওয়া-পাওয়াগুলো শেষ হতে বসেছে। আহেলির নরম গাল বেয়ে জল নেমে আসছিল, যখন সে আঁকড়ে ধরে বসেছিল তার মায়ের দেওয়া বেনারসি। আহেলির সংসারের স্বপ্ন চোখের সামনে মিলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে, আর তার আঙ্গুল আরও চেপে ধরছিল তার ফেলে আসা সব কিছু, সব ঘটনা, সব স্মৃতিকে।

কেউ নেই যে একবার তাকে জিজ্ঞেস করবে "কেমন আছো তুমি?" আজ অন্তু আর মাধবীর জন্য খুব ঈর্ষা হচ্ছে আহেলির।

জানলা থেকে নেমে এসে আলো জ্বালল। ল্যাপটপ আর মোবাইল বন্ধ করে ডায়েরির একটা পাতা ছিঁড়ে নিল, আর লিখতে বসল একটা ছোট গল্প- আহেলির গল্প। তার না পাওয়া, বিতৃষ্ণা, অভিমান, রাগ, আক্ষেপ সব কিছু নিয়ে। পাশে ওষুধের শিশিটা তখনও রাখা।

চিঠির শেষ প্রান্তে এসে, কলম যখন থেমে এল, আহেলির ঠোঁট তখন ভয়ে লজ্জায় কাঁপছে, কপালের ঘাম নেমে এসেছে গাল বেয়ে। বার বার ফিরে তাকাছে ঘরটার চারপাশ। মায়ের দেওয়া শাড়ি, পায়ে বাঁধা নুপুর, কবিতার পুরনো ডায়েরি, তার সমস্ত স্মৃতি সব কিছু যেন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

এত কিছুর ঘোরের মধ্যে খেয়াল হল, দরজায় কেউ যেন বেল দিচ্ছে। "এমন সময়? কে আবার? কাজের মাসি কে তো সকালেই ছুটি করে দিলাম। আর আজ তো কোনও পার্টিরও নিমন্ত্রণ নেই। কোনও বন্ধুরও তো আসা কথা নেই। তবে কি মোবাইলে সাড়া না পেয়ে..."। সত্যি বলতে আহেলি একটু একান্ত একলা মুহূর্ত খুঁজছিল; শুধুমাত্র নিজের জন্য। এই সময় কোনও বন্ধু, আত্মীয় বা সেলসম্যান কারওর আগমনই তার পক্ষে বরদাস্ত করা সম্ভব ছিল না।
নিজের অজান্তে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে নিস্তব্ধভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল , "যদি আপদ বিদেয় হয়..."।

"আহেলি?......মিস আহেলি?", এক পুরুষ কণ্ঠ বার বার ডেকে চলেছে। "অচেনা" না "চেনা" সেটা বোঝার ক্ষমতাও তার ছিল না হয়ত, যখন ঘামে তার শরীর স্নান করে যাচ্ছিল উৎকণ্ঠায়। আহেলির কিসের ভয়? দরজা খুলতেই বা এত দ্বিধা কেন?
অগত্যা আহেলি আসতে আসতে এগিয়ে দরজা খুলল। অন্ধকার ঘরের এককোণে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে শুধু, আর তারই মধ্যে থেকে কোনও রকমে মুখ বাড়িয়ে সাড়া দিল।

এক গাল হেসে এক বছর আঠাশের যুবক, "ভেরি সরি, ডিস্টার্ব করলাম বলে। সাড়া পাচ্ছিলাম না বলে, নাম ধরে ডাকতে হল। কিছু মাইন্ড করবেন না প্লিজ। কেমন আছেন আপনি? আমি সঞ্জীব। পাশের ফ্ল্যাট থেকে আসছি। পথশিশুদের নিয়ে একটা নাচের অনুষ্ঠান ছিল। তাই আপনাকেও ডাকতে এসেছিলাম। আগাম নিমন্ত্রণ জানানো হয়নি ব্যস্ততায়। তাই ভাবলাম একেবারে সঙ্গে করেই নিয়ে যাই..."

আহেলি তখনও দরদর করে ঘেমে চলেছে, সব কিছু যেন ঘোরের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে। কাঁপা ঠোঁটে কিছু বুঝতে না পেরে বলল, "মানে...? আমি...হঠাৎ আমি কেন?" কিছুটা থেমে প্রচণ্ড বিরক্তির সাথে সে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইল। আসলে চোখে চোখ রেখে কথা বলার ইচ্ছে বা সাহস সবটাই ফুরিয়ে এসেছিল তার।

বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সঞ্জীব আরও আগ্রহ নিয়ে বলল, "হ্যাঁ আপনিও। সব কটা ঘর থেকেই কেউ না কেউ এসেছে। শুধু আপনি..."

কথাটা শেষ করার আগেই আহেলির বিরক্তিময় উত্তর, "বললাম তো, আমার এখন সম্ভব নয়। আপনি আসতে পারেন। আমি এখন ব্যস্ত আছি।"

"ব্যস্ত আছেন, অন্ধকার ঘরে?" শ্লেষের সাথে সঞ্জীব তাকালো ওর চোখের দিকে।

"আমি ঘুমোচ্ছিলাম...আর আপনাকেই বা এত অহেতুক কৈফিয়ত দিতে যাব কেন? এখুনি চলে যান। নাহলে..."

"পায়ে নূপুর বেঁধে ঘুমোচ্ছিলেন?" সঞ্জীবের কেমন যেন একটা বেশ খটকা লাগল।

আহেলি জোরের সাথে দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হল। কিন্তু দরজাটা বন্ধ হবার শেষ মুহূর্তে, সঞ্জীব পাল্লাটা ঠেলে ধরল আহেলির চোখের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে।

"একি? এভাবে আপনি... দরজা আটকাচ্ছেন? এর মানে কি? আমি কিন্তু সিকিউরিটি ডাকব...", আহেলি কিছু করে হোক, নিস্তার পেতে চাইছিল এই ঝঞ্ঝাট থেকে। আর দরজা টেনে ধরাতে তার হৃদস্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে গেল।

"একটা কথা বলে রাখি। হয়ত আমি খুব বড় ভুল করেছি আপনার কাছে এসে। নাহলে......", বেশ কিছুক্ষণ থেমে আবছা অন্ধকারে ঘরের ভিতরের দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনি খুব বড় ভুল করতে চলেছেন।"

"ভুল" এই শব্দটায় আহেলির সাড়া শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল? "কিসের ভুল, কেন? আমি কোনও ভুল করিনি...", সংশয়ে কথাগুলো বলতে বলতে কেমন যেন হঠাৎ তার স্বর জড়িয়ে এল, চোখ দিয়ে অঝোরে নেমে আসতে থাকল জল। স্বাভাবিকভাবেই এই সামান্য কথায়, বা কোনও প্রায়-অচেনা পুরুষের উদ্ধত বাক্য বিনিময়ে কান্নায় ভেঙে পড়ার মত কিছু ঘটে না। কিন্তু তার মানসিক পরিস্থিতিটা এতটাই সরু সুতোর আলম্বে দাঁড়িয়েছিল, যে এই সামান্য শব্দটা তাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।

"একি তুমি কাঁদছ কেন? কি হয়েছে তোমার? কিছু একটা ভুল বুঝছ তুমি", সঞ্জীব "ফরম্যালিটির" তোয়াক্কা না করে বন্ধুর মত জিজ্ঞেস করল।

"আমি ভুল বুঝিনি? ভুল করিনি!", বিড়বিড় করতে করতে চেঁচিয়ে উঠল আহেলি, যখন কান্নায় ভেঙে আসছিল তার গলা। "সব্বাই ভুল বুঝল... আর তোমাকে আমি এসব এত বলব কেন? কে হও তুমি? বেরিয়ে যাও। আমাকে একলা ছেড়ে দাও।"

এমন বিচলিত পরিস্থিতিতেও উত্তর এল, "বন্ধু। "

"সেটুকু ভেবেছিলাম বলেই ডাকতে এসেছিলাম। কচিকাঁচারা এক মাস ধরে প্র্যাকটিস করেছে আজকের জন্য। সবাই গেলে ওরাও উৎসাহ পেত, এই আর কি। জানিনা এভাবে বলা উচিত কিনা, আমি তোমাকে ভালভাবে চিনিও না। তোমারও জীবনেও নিশ্চয় এমন কোনও মুহূর্ত এসেছে যখন তুমি কোনও একটা কিছুর জন্য অনেক চেষ্টা করেছ, কিন্তু তোমাকে সাহায্যের হাত খুব একটা কেউ বাড়িয়ে দেয়নি। মনে রাখবে তার জন্য তুমি দোষী নও। তোমার চারপাশে থাকা লোকগুলো অনেক বেশি করে দায়ী।আজকেও সেইটাই ঘটতে চলেছে। ওরাও মুখিয়ে ছিল সবার জন্য। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার আগের পাঁচটা ঘরেও একই ভাবে দরজা ঠেলেছে মুখের ওপর। থাক সে কথা। তাই নিতান্ত বেপরোয়া হয়েই তোমার সাথে ব্যবহার করলাম। আমি দুঃখিত। হয়ত ওরা আরও বেশি দুঃখ পাবে। ওরা তো কোনও ভুল করেনি; ওদের জন্য দায়ী আমি, তুমি আর আরও সবাই যারা এই সামান্য কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে অক্ষম।"

আরেকটু থেমে বলল, "ভুলগুলো ছোটই থাকে। আগে থেকে শুধরে নিলে, সেটা কখনও মহীরুহ হতে পারে না। আমি জানিনা, কি কারণে তুমি কাঁদছ। হয়ত তুমি কোনও ভুলের মাশুল গুণছ আজকে, যার জন্য তুমি নিজে দায়ী নও। আমি চললাম। আর সুযোগ পেলে আমাদের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যেও। ভালো থেকো।"

দরজাটা ভেজিয়ে, সঞ্জীব নিঃশব্দে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। একবারের জন্যেও ফিরে তাকালও না। সঞ্জীব হয়ত আহেলির পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিল। বুঝেছিল একটা মানুষ যখন একটা সঠিক প্রশ্নের প্রতি অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করছে, তখন তার মনের পরিস্থিতি নিশ্চয় ঠিক নেই। আহেলির অহেতুক বিরক্তি, কান্না, কপালের ভাঁজে জমতে থাকা উৎকন্ঠার ঘাম - সঞ্জীব তাই শত অচেনা হওয়া সত্বেও, শেষের কথাগুলো ইচ্ছে করেই বলেছিল। কথাগুলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিলে যাচ্ছিল আহেলির সাথে। সঞ্জীব চলে যেতেই, সে দরজা বন্ধ করে, ভয়ে ককিয়ে উঠল। "কি করতে চলেছিলাম আমি !" আহেলি গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল নিজেকে। চিঠি আর ঘুমের ওষুধের শিশিটাকে বাথরুমের বিনে ফেলে দিয়ে, বসে পড়ল মেঝেতে।

একেবারে শিয়রে দাঁড়িয়েছিল মৃত্যু, কিন্তু দরজায় কড়া নেড়েছিল কোনও অজানা বন্ধু। "ভুল" এই শব্দটা আহেলিকে একটা ঘোরের মধ্যে রেখেছিল। বার বার ভাবছিল, "কলেজের শেষ বেলায় অন্তুকে অপমান করাটা ভুল ছিল কিনা, অথবা জীবনের সাধারণ চাহিদাগুলো আরও বাড়িয়ে নেওয়া ভুল ছিল কিনা, উদ্দাম জীবনে রঙগুলোতে ভুলের বিষ মিশে যাচ্ছিল কিনা; অথবা আজ কোনও ভুল করতে বসেছিলাম কিনা। আমি চলে গেলেও পৃথিবীর কি এসে যায়। কিন্তু থাকলে?" জীবনের বোঝাটা অনেক বেশি হয়ে গেছিল ঠিকই, কিন্তু কিছু কথা তাকে আবার ভাবতে বাধ্য করল। সাধারণত এই পরিস্থিতিতে একটা মানুষ নিজেকে শেষ করার আগেই শেষ হয়ে গিয়ে থাকে। ভাবনা-বিবেচনা এসবের অবকাশ থাকেনা। কিন্তু সঞ্জীবের সাথে বাদানুবাদ তার আত্মহননের ঘোরটাকে কাটিয়ে দিয়েছিল।

আসতে আসতে থিতিয়ে আসছিল তার মন, সাওয়ার চালিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল নিজের "সুইসাইড নোটের" কথা ভেবে। জলের বিন্দুগুলো নেমে আসছিল ওর চুল, চোখ, ঠোঁট, শরীর বেয়ে। আর ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, এতদিন ধরে জমতে থাকা সব ক্ষোভ। আহেলি বুঝতে পারছিল, "হেরে গেলে কেউ মনে রাখবে না।" বড্ড ইগো আহেলির। হেরে যেতে পারেনি সে। তাই নিশ্চুপ বাথরুমে, তার ভুল আর অধরা স্বপ্নগুলো 'বাকেট লিস্ট' হয়ে যাচ্ছিল। সব কিছুরই একটা নতুন শুরু আছে।
সেদিন সঞ্জীব না এলে, হয়ত ঘটনাটা অন্য রকম হত। কিন্তু হয়নি। সত্যি বলতে, আহেলি আসতেও পারেনি অনুষ্ঠানে। কিন্তু পরদিন সঞ্জীবের সাথে যে করেই হোক দেখা করেছিল।

"কেমন আছো তুমি?"

উত্তরে আহেলি হেসে বলেছিল, "ধন্যবাদ! এখন ভালো আছি"।

(ক্রমশ প্রকাশ্য, পড়তে থাকুন। পরবর্তী অংশ পরের প্রকাশনায়।)

ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক-নবপত্রিকা

No comments:

Post a Comment